হযরত মাওলানা শাইখ মাহমুদ আলম মেনানগরী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
আনুমানিক ১৯০৬ ইংরেজি সনের কোন তারিখে রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলার মেনানগর গ্রামে মাওলানা শাইখ নুর মোহাম্মাদ (রহঃ) এর ঘরে জন্ম নেন একজন সুন্নী হানাফী শিশু। চারদিকে খুশির বন্যা। পিতা মাওলানা নুর মোহাম্মাদ (রহঃ) নিজের প্রথম পুত্রের জন্মের খুশিতে মহান আল্লাহ্ পাকের দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। প্রিয়তম পুত্রের নাম রাখলেন মাহমুদ আলম।কে জানতো এই ছোট্ট শিশু বড় হয়ে মহান আল্লাহ্ পাকের দ্বীন ইসলাম কায়েম করতে একজন অগ্রগামী মুজাহিদের ভুমিকায় আবির্ভুত হবেন।
শিশুকাল থেকেই মাহমুদ আলম অত্যন্ত মেধাবী এবং আদব কায়দায় সকলের প্রিয় হয়ে উঠলেন। পিতার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করার পরে সৈয়দপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে জামাতে উলা সমাপ্ত করেন। পিতার নির্দেশে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের রামপুরের মাদ্রাসায়ে আলিয়াতে ভর্তি হলেন।তখন ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ একটি দেশ ছিল। দীর্ঘ সাত বছর তিঁনি তাফসীর, এলেমে হাদিস, এলেমে ফেকাহ ইত্তাদি বিষয় আলাদা আলাদা ভাবে উচ্চ সনদ লাভ করেন।মদিনা শরিফ থেকে আলেমগন এসে সেই সময় তাঁদেরকে সনদ প্রদান করেন।
তরিকায় বায়াতগ্রহন ও খেলাফত লাভঃ
নখশবন্দিয়া মোজাদ্দেদিয়া আউলিয়াগণ বিশেষ করে খানকায়ে এনায়তিয়ার মাশায়েখ গণ ছাত্রাবস্থায় তরিকার সবক দিতেন না। কিন্তু মাওলানা মাহমুদ আলম (রহঃ) সেই সময় খানকায়ে এনায়তিয়ায় নখশবন্দিয়া মোজাদ্দেদিয়া সিলসিলায় বায়াত গ্রহন করেন শাহ হেমায়তুল্লাহ খাঁন (রহঃ) এর নিকট।প্রথম পীর সাহেবের ওফাতের পরে মুফতি হযরত শাহ হেদায়তুল্লাহ খাঁন হুজুরের নিকট বায়াত গ্রহন করেন।
মাওলানা শাহ মোহাম্মাদুল্লাহ খাঁন (রহঃ) এবং মাওলানা মাহমুদ আলম (রহঃ) উভয়ই তখন ছাত্র। দুজনের মধ্যে অত্যন্ত অন্তরিক ও ঘনিষ্ট সম্পর্ক। প্রায়ই আপন পীর সাহেব হুজুরের সাহেবজাদা মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ খাঁন (রহঃ) এসে মাওলানা মাহমুদ আলম (রহঃ) এর বিছানায় শুয়ে ঘুমাতেন। এমন একদিন দুপুরে দুজন বন্ধু শুয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। এমন সময় মাওলানা মাহমুদ আলম (রহঃ) স্বপ্নে দেখেন তাঁর পীর সাহেব কেবলা মুফতি শাহ হেদায়তুল্লাহ খাঁন (রহঃ) ঐ ঘরে তাশরিফ নিয়েছেন। স্বপ্নের মধ্যেই দেখলেন তিনি উঠে গেলেন ঘুম থেকে। পীর সাহেব কেবলা বললেন মোহাম্মাদুল্লাহ ঘুমাচ্ছে? আচ্ছা ঠিক আছে ঘুমাক। এই চাবিটা তোমার কাছে রাখো। মোহাম্মাদুল্লাহ ঘুম থেকে উঠলে তাকে দিও।এইবলে একটি চাবির গোছা মাওলানা মাহমুদ আলমের নিকট দিয়ে পীর সাহেব কেবলা চলে গেলেন। মাহমুদ আলম ভাবলেন হুজুরকে জিজ্ঞেস করা হল না তিঁনি কোথায় যাচ্ছেন? ছুটে গেলেন ঘরের বাহিরে।কিন্তু হুজুরকে আর খুঁজে পেলেননা। এমন এক অস্থিরতম মুহুর্তে ঘুম ভেংগে গেল। ঘুম থেকে উঠে দেখলেন তখনো মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ (রহঃ) ঘুমাচ্ছিলেন।
এই আশ্চর্য স্বপ্নের বিবরণ শুনে পীর সাহেব মুফতি শাহ হেদায়তুল্লাহ খাঁন (রহঃ) খেলাফত প্রদান করেন মাওলানা মাহমুদ আলম (রহঃ) কে এবং বাংলাদেশে নিজ জন্মভুমিতে ফিরে দ্বীন ইসলামের খেদমতের নির্দেশ দেন।
নিজ দেশে ফিরে এসে মাওলানা মাহমুদ আলম (রহঃ) ইসলামের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন।
কারামত প্রকাশ এবং বাতিলদের সাথে বাহাসঃ
হুজুর বাতিলদের বিরুদ্ধে বাহাসে অংশ নেন প্রথম জীবনে। হানাফি মাজহাব এবং সুন্নি আকিদার দুশমন দের জন্য আতংক রুপে আবির্ভূত হন।রহিমাপুর বড় মসজিদের ইমামের দায়িত্ব গ্রহন করেন। দলে দলে লোকেরা হুজুরের হাত ধরে বায়াত গ্রহন করে। তরীকায়ে নখশবন্দিয়া মোজাদ্দেদিয়ার প্রশিক্ষন লাভ করে উত্তারঞ্চলের অনেক নারী পুরুষ আত্মশুদ্ধি লাভ করে।
রহিমাপুর মসজিদে ঈদের নামাজ পড়াতে গিয়ে একবার যমুনাশ্বরী নদীর তীরে কোন নৌকা পেলেন না। ঝড় বৃষ্টির দিনে নিজের এক জন সংগী নিয়ে পাগড়ি বিছিয়ে নদী পার হয়ে গিয়েছিলেন। দূর থেকে কেউ দেখে ফেলায় ঘটনা প্রচার হয়ে গিয়েছিল মুখে মুখে।
বাস্তবে মাওলানা মাহমুদ আলম (রহঃ) অত্যন্ত প্রচারবিমুখ ছিলেন। তরিকার আদব ও গোপনীয়তা রক্ষা করে চলতেন। শরীয়ত প্রতিপালনের ব্যাপারে খুব কঠোর ছিলেন। মিলাদ ও কিয়াম পছন্দ করতেন। হুজুরের হলকায় মোরাকাবা ও খতমে খাজেগানের মাহফিল বসত নিয়মিত।
পিতার প্রতিষ্ঠিত মেননগর নুরুল হুদা মাদ্রাসার নামের সাথে বরকতের জন্য মোজাদ্দেদিয়া যুক্ত করেন।নতুন নাম দেন ” মেনানগর নুরুল হুদা মোজাদ্দেদিয়া দাখিল মাদ্রাসা’। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে সত্তরের দশকের প্রথমেই মাদ্রাসাটি সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে।
মক্কা শরীফে হজ্ব পালন করতে গিয়েছিলেন এবং প্রায় প্রতি বছর সেরহিন্দ শরীফ ও রামপুরের মাহফিলে শরিক হতেন।যাওয়ার সময় বিশাল কাফেলা সাথে নিয়ে যেতেন।
মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ খাঁন (রহঃ) গদ্দিনিসীন হয়ে যখন বাংলাদেশ সফরে আসতেন তখন রংপুরের মেনানগরে আসতেন প্রথমেই । মাওলানা মাহমুদ আলম (রহঃ) কে ” ভাই আলম পীর ছাহেব ” বলে সম্বোধন করতেন। অবশ্য মাওলানা মাহমুদ আলম (রহঃ) সবসময় মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ খান (রহঃ) কে অত্যন্ত সম্মান করতেন, আদবের সাথে খেদমত করতেন এবং “হযরত সাহেব ” বলে সম্ববোধন করতেন। কারন মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ খান (রহঃ) ছিলেন তাঁর পীর সাহেবের আওলাদ এবং নখশবন্দিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরীকার মহান কাণ্ডারি।
মাওলানা শাইখ মাহমুদ আলম। (রহঃ) ইন্তেকালের পুর্বে তাঁর দ্বিতীয় সাহেবজাদা মাওলানা আব্দুল্লাহ (মা:জি:আ:) কে খেলাফত ও পাগড়ি প্রদান করেন।
হযরতের আওলাদ গনের নাম:
শাইখ হামিদুল্ললাহ
শাইখ আব্দুল্লাহ
শাইখ বাকী বিল্লাহ
শাইখ সালামতুল্লাহ
শাইখ হাশমতুল্লাহ
হযরত মাহমুদ আলম (রহঃ) ছিলেন আরব বংশোদ্ভূত। তাঁর পুর্বপুরুষ আরব দেশ থেকে বংগদেশে এসেছিলেন। হুজুর ছিলেন দীর্ঘ দেহী।উচ্চতা আনুমানিক ছয় ফুটের কাছাকাছি।দেহের রঙ ফর্সা। মুখ ভর্তি ঘন লম্বা দাড়ি ছিল। চেহারায় ছিল গাম্ভীর্য। কথা কম বলতেন।ভ্রু মোবারক ছিল ঘন।শেষ বয়সে লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করতেন।গোল গলা সাদা জুব্বা পরিধান করতেন। সাদা কাপড়ের গোল টুপি ও সাদা পাগড়ী ব্যাবহার করতেন। ঈদের কিংবা জুম্মার দিন আতর সুরমা লাগয়ে পাগড়ী মাথায় দিয়ে যখন বের হতেন অনেক অাকর্ষনীয় লাগত দেখতে। অধিকাংশ সময় তসবীহ হাতে থাকত।
ইন্তেকাল: ১৯৯৩ ইং সনে রংপুরের মেনানগরে ইন্তেকাল করেন। মেনানগরে নিজবাড়ির পাশেই হযরতের মাজার শরীফ অবস্থিত।
(সংগৃহীত)